হাসান মাহমুদ বজ্রের ঈদের বিশেষ ছোটগল্প || ঈদ ও অভাগা পিতা || মাসিক বজ্র
- ঈদ ও অভাগা পিতা
-হাসান মাহমুদ বজ্র
দুপুরের খাঁ খাঁ রোদে চারদিক ঝলসানো। বিস্তৃত মাঠের পাকা সোনালি ধানে হালকা বাতাস লেগে ঝিরঝির এক শব্দের সৃষ্টি করে। কাঠফাটা রোদে ধান কাটছে কৃষকরা। খেতের আইল ধরে সাত আট বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এলো। পরনে ছেঁড়া প্যান্ট খালি গা সাক্ষী দিচ্ছে তার বাবার দারিদ্রতার। ময়লা শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। এসে খেতের এক পাশে দাঁড়িয়ে ডাকলো- আব্বা আব্বা। ফিরে তাকালো বৃদ্ধ করিম মিয়া। কাঁধের গামছাটা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে জবাব দিলো, কিরে বাপ? আব্বা আব্বা আমারে ঈদের নতুন জামা কিনে দিবা না? ফিরে তাকালো অন্যান্য কৃষকরা। চেয়ে আছে করিম মিয়ার দিকে। তারা ভাবছে কি জবাব দিবে করিম মিয়া। তারা জানে তাদের কারওই সাধ্য নেই ছেলে মেয়েকে নতুন জামা কিনে দেওয়ার। হাতের গামছাটা দিয়ে ছেলের মুখের ঘাম গুলো মুছে একটি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে করিম মিয়া উত্তর দিলো, হ রে বাপ, দিমুনে। -কবে দিবা আব্বা? তুমিতো সেই কোনদিন থেকেই দিবা দিবা কইতাছো, -কবে দিবা? দিমুনে বাপ, ধান গুলো বিক্রি করেই দিমুনে। খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ির দিকে ছুটেলো ছেলেটি। সেই দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে করিম মিয়া। চোখে তার এক পৃথিবীর শূন্যতা। মসজিদের জোহরের আজানের সুর একসাথে বেজে উঠছে চারদিকে। গামছাটা কাঁধে নিয়ে সবাই চললো মসজিদের দিকে।
ঈদের বাকি আর দু'দিন।। করিম মিয়ার শুকনো মুখ। জমির ধান বিক্রি করে যা পেলো ধান কাটা শ্রমিকদের মজুরি দিয়েই যা থাকলো তা হলো জমির মালিকের। সবটুকু দিয়ে দিলেও মালিক আরো পাওনা থেকে যায়। করিম মিয়ার জমি জমা নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করে। এবারে ধান ভালোই ফলেছে। তা দেখে করিম মিয়া মনে মনে ভাবছিলো এবারের ঈদে ছেলে মেয়েদের নতুন জামা কিনে দিবে সে। গত দুই-তিন বছর ছেলে মেয়েদের কিছুই কিনে দিতে পারেনি । তখন ছেলে মেয়েদের নতুন জামা কিনে দিতে পারবে বলে করিম মিয়ার মুখে যে হাসি ফুটছিলো, তা এখন তীব্র যন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে। ধান বিক্রি করে তার জন্য অবশিষ্ট কিছু নেই। বাবার পাশে বসে থাকা ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রনা করে উঠলো। বুক চেপে ধরলো করিম মিয়া। এই মুহুর্তে এই যন্ত্রনার চাইতে বড় কোন যন্ত্রনা হয়তো কারো জীবনে হয় না। ছেলে মেয়ের মুখে হাসি ফুটাতে না পারার যন্ত্রনা শুধু করিম মিয়ার মতো অসহায় পিতারাই বুঝে।
ছেলে মেয়ের ঈদের জামা কেনার জন্য অনেক আগ থেকেই বিড়ি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে করিম মিয়া। বিড়ির টাকা গুলো জমিয়ে রেখে ছিলো বিচানার নিচে। এক বুক আশা নিয়ে টাকা গুলো বের করলো সে। গুনে দেখলো শ খানেক টাকা জমেছে। খুব যতনে টাকা গুলো জামার পকেটে নিলো। বিকেলে সেগুলো নিয়ে গাঁয়ের বাজারে গেলো করিম মিয়া। কাপড়ের দোকান গুলোতে সাজানো কত রঙ বিরঙের জামা। দু' টাকা পাঁচ টাকার খুচরা শ খানেক টাকা নিয়ে মলিন মুখে তাকিয়ে আছে সেদিকে। জমানো শ খানেক টাকা গুলো পকেটে নিয়ে করিম মিয়ার মুখে যে হাসির রেখা ফুটে ছিলো, বাজারে এসে নিমিষেই সে হাসি উবে গেলো। কত মানুষ কত উল্লাস করে নিজ নিজ ছেলে মেয়ের জন্য নতুন জামা কিনছে। সেদিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে করিম মিয়া। তার দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুকণারা।
ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
Comments
Post a Comment