কবি হাসান মাহমুদ বজ্রের ছোটগল্প- || অনাধিকার প্রেম || মাসিক বজ্র - আগষ্ট-২০১৯


অনাধিকার প্রেম

-হাসান মাহমুদ বজ্র


দাওয়াতটা বন্ধু অগ্রিম দিয়ে রেখেছিলো। আমার বন্ধুর এক দুর সম্পর্কের বোনের বিয়ে। না করতে ইচ্ছে হলো না, বিয়েতে যেতে আমার এমনিতেই ভালো লাগে। একেক জনের কাছে একেক কারনে আমার কাছে একাধিক কারণে। তাই এক কবি সম্মেলমের দাওয়াত উপেক্ষা করে বন্ধুর সাথে বিয়েতেই গেলাম। হলুদের দিন সন্ধ্যায় আমরা তিন বন্ধু গিয়ে পৌঁছাই সেখানে। অর্ধেক রাত কাটার পর ঘুম পাচ্ছিলো বেশ। কিন্তু ঘুমানোর তেমন কোনো ভালো ব্যবস্থা  চোখে পড়লো না। তারপর আবার উচ্চ আওয়াজের গান। পরপর সাউন্ট বক্সের ঘুমঘুম শব্দে বিরক্ত ধরিয়েছে রাতের গায়ে। অসস্তি লাগছিলো। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। রাত বারোটার পর  হলুদ সন্ধ্যার প্রথম পর্ব শুরু হলো। নিকট আত্মীয় হতে শুরু করে পাড়া-পড়শি বন্ধু বান্ধব সবাই কনের গায়ে হলুদ ছোঁয়াতে ব্যস্ত। নম হলুদ ছোঁয়া হলেও এখন আর আগের মতো কনের গায়ে হলুদ ছোঁয়ানো হয় না, এতে সাজ নষ্ট হবে বটে। এখন কেক কেটে একে অপরকে খাওয়ানো আর সেই দৃশ্য কেমেরায় ধারণ করাই মূখ্য বিষয়। দ্বিতৃয় পর্ব মেহেদী লাগাবে কনের হাতে, অভিক্ষ সখীদের তিনজন সেই দ্বায়িত্ব পালন করতো স্টেজে উঠলো। আর অন্য সখীরা গানের তালে তালে নৃত্য শুরু করলো স্টেজের সামনে। এতে আমি বেশ অবাক হলাম, সখির বিয়েতে সখীদের নৃত্য বেশ স্বাভাবিক বিষয় হলেও এই অজপাঁড়া গাঁয়ে এটাই অনেকটাই অনাকাঙ্গিত। স্টেজের সামনে শতশত নারী পুরুষের সামনে গ্রামের মেয়েরা লজ্জাবোধ করবে আমার ধারণা সেটাই ছিলো। কিন্তু এই মেয়েরা লজ্জাবোধ তো করলই না, বরং স্ব-ইচ্ছায় নিজেরা নাচতে শুরু করে দিলো। শুধু এটাই নয়, তাদের সাজ, অঙ্গ ভঙ্গি সব দেখে আমার মনে হচ্ছে আমি শহরের কোন পার্টিতে আছি। আমাদের গাঁয়ে আধুনিকতাটা সম্ভবত্য একটু বেশিই চলে এসেছে। যাক, না বলি সেসব কথা। যেখানে মানুষ দু'বেলা খাবার পায় না, সেখানে বিলাসিত জন্মদিনের উৎসব। দশ বেলা উপোস থেকে এক বেলা কোরমা পোলাউ খাওয়া এই আমাদের বিলাসিতা। এই পূর্ণ কোমারি দেহের নৃত্য দেখে ভালোই লাগছে, এই হয়তো বয়সের চোখ, বিবেকের নয়। আনমনা হয়ে সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। হঠাৎ বন্ধু এসে চায়ের কাঁপটি সামনে ধরলো, আর সামনের দিকে ইঙ্গিত দিলো। আমি কিছুই বুঝলাম না, ওর চেহারার দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। আমি কিছু বুঝনি বুঝতে পেরে কানের কাছে এসে বললো- সামনের দিকে তাকা, লাল উড়না গায়ে দেওয়া মেয়েটি তোর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, অনেকের মাঝে আমার দু'সারি আগে একটা মেয়ে বসে আছে। সবাই স্টিজের দিকে মুখ করে বসলেও আমরা বসেছি স্টিজের পাশের দিকে। মেয়েটি স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ভাবলাম বন্ধু মজা নিচ্ছে। কিন্তু না, পরক্ষণে দেখলাম আসলেই সত্যি, মেয়েটি একটু বেশিই তাকাচ্ছে। লাল শাড়িতে তাকে বেশ দেখাচ্ছে, এমন সুন্দর লাগছে তাকে- মনের ভিতর  কবিতারা আন্দোলন শুরু করে দিলো। ভাব না থাকলে কবি হওয়া যায় না, ভাব ছাড়া কবিতা হয় না। কবি কবিতার ভাব তখনই আসে যখন তার মনের ভিতর কোন কিছু গভীর ভাবে রেখাপাত করতে সক্ষম হয়। মেয়েটি ও তেমনই। কবিতার মতো। যদিও নারীর চাইতে সুন্দর করে আল্লাহ পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করেনি, তবুও এখন পর্যন্ত খুব কম নারীই আমাকে মুগ্ধ করতে পেরেছে। তার মধ্যে এ মেয়েটি অন্যতম, যেন একটি কবিতা।

ছেড়ে রাখা চুল মেঘের মতো,  যেন এখনি জন্ম দিবে এক মাতাল কাল বৈশাখীর। যার এলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাবে কবি,  আন্দোলিত হবে কবিত্ব, আর প্রস্রব করবে একটি কবিতা, জন্ম দিবে এক কবিতার গল্প। যার শব্দের ডানায় চড়ে দু'জনে উড়ে চলে যাবে কোন এক স্বপ্নের রাজ্যে, সুখের মহলে। সেখানে আশোক ফুলের সাজানো বাসর, চাম্পা বেলি আর শিউলির সুভাসিত এক কুসুম কাননে  লেখা হবে এক স্বার্থক বাসরের গল্প একটি স্মৃতির কবিতা। যেখানে আলতো ছোঁয়ায় শিহরণ জাগাবে রাতের গায়ে। যেখানে সখির চুলের সুভাসে কবি হবে মাতাল। সুখির মুখটি যেন কোন এক স্বপ্নের অরণ্য, যেখানে একটি চুম্বন দিতে পারলে কবিত্ব স্বার্থক হবে  কবি পাবে পূর্ণতা। যেন সখির কেশে গাঁথা আছে তষ্নাত্ব কবির সকল চাওয়া পাওয়া আর বাসনা। চোখ দু'টিতে তার ছুঁয়ে আছে করতোয়া, পদ্মার তীর বেয়ে পড়েছে গঙ্গায়। প্রশান্ত সাগরের প্রশান্তি নিয়ে গিয়ে পড়েছে আরব সাগরে। সেখানে লেখেছে বিজয়, লেখেছে সকল নদীর আর সাগরের প্রেমের ইতিহাস। আমার আর তার বাসরের কথা। এক প্রশান্তির গল্প।

রাধা কৃঞ্চের বাঁশির যদি সখির নাকের মতো হতো, তাহলে ইতিহাসে রাধা কৃষ্ণের বাঁশির জায়গায়  সখির নাকের কথা লেখা হতো। আহা,  বিধাতার প্রজ্ঞা ও সুক্ষতা বুঝি নারীর নাকে লেখা। আমার যদি অধিকার হতো ছুঁয়ে দিতাম সে নাক। যতনে পরিয়ে দিতাম একটি ছোট নাকফুল। সে লজ্জায় রক্তবর্ণ হয়ে হাসতো। বিনিময়ে আমি পেতাম পূর্ণতা।

পৃথিবীর বাগিছায় বাগিছায় আমি হেটেছে, নিজ হাতে কত ছিঁড়েছি  গোলাপ, সুভাস নিয়েছি কত রক্তিম পাপড়ির। কত শত পাপড়ি ছেঁড়া হলো, দেখা হলো কত গোলাপ,  তার ওই ঠোটের মতো একটি গোলাপ ও আমি দেখিনি। এ যেন শখের বাগিছার যতনে ফুটানো দু'টি গোলাপের পাপড়ি। স্নিগ্ধ অপরূপ রং তার। সেই পাপড়ির গায়ে পৃথিবীর সব কোমলতা মাখা, সব বাসরের সুখ মেশানো, যেন নেশা। আহা, আমি যদি ভ্রমর হতাম, ছুঁয়ে দিতাম সে গোলাপ। সেই নিদারুন উষ্ঠদ্বয়। একি নেশা ওখানে, শিহরিত মন প্রাণ দেহ পিঞ্জিরা। আজ আমার জানা হলো আমি অপূর্ণ। আমি এক অপূর্ণ কবি। আমি পূর্ণতা পেতে চাই, ছুঁয়ে দিতে চাই সেই মায়াবী ঠোট ছুঁয়ে দিতে চাই তার স্নিগ্ধ ললাট। অপূর্ণ জীবনে তারে পেলে পূর্ণ হবে। স্বার্থক হবে কবিত্ব আর কবিতা। বেয়ে আসা ঘাড় যেন তার ধুধু সোনার প্রান্তর, কোমলতা আর স্নিগ্ধতায় গড়া এক স্বপ্নের দেশ চলে গেছে উদার সেই আসমানে। তার বুকে গভীর রজনীর চাঁদ জোসনা ছড়ায় প্রান্তরে প্রান্তরে ফুল আর পল্লবে। সেই আলোতে শিশির করে ঘাসের বুকে বাসর।

তার অপলক দৃষ্টির নেশা মাখানো তীর সোজা গেঁথেছে পিঞ্জিরায়।  বন্ধুত্ব হয়েছে খানিকে, জমে গেছে হিমালয় সম প্রেম। হয়েছে পরিছয়, আর কিছু কথোপকথন। সবেই হয়েছে, সবই হয়েছে চোখে চোখে। মানুষ সুন্দরের পুজারী। রূপ সেতো সকলের কামনা। আমার যে বন্ধুকে উপলক্ষ করে বিয়েছে গিয়েছিলাম সেই বন্ধুকে ব্যাপারটা বলেলে সে  বন্ধু কেন জানি আমাদের একে অপরের দিকে তাকাতে বাধা দিচ্ছিলো। কারণ সে চায় না আমি তার সাথে ভাব করি। সুন্দর সেও তো কামনা করে। তার বাধা আর তার চাওয়া আমাদের চোখে চোখে কথোপকথনকে থামাতে পারেনি। অচেনা কুমারী যেন জনম জনমের চেনা, যেন আমাদের হাজার বছরের পরিছয়। তার হাসিতে ঝড়ে কবিতার শব্দরাজি, সেই শব্দ পিঞ্জিরায় এসে অতুল সোহাগে জন্ম দেয় এক পূর্ণ বাক্যের। তার পর বাক্যের ললাটে বাক্যের চুম্বনে পস্রব হয় একটি কবিতার। সেই কবিতা শিরোনাম হয়- অনাধিকার প্রেম।

চুল তার রাতের আঁধার যেন নিশুতির ছায়া
মুখ ললাট বুকে একি মায়া জোছনার ছায়া
স্নিগ্ধ কেশ উড়ে যেন কালো মেঘের পাল
তার রূপে মুগ্ধ হয়ে কবি হয়েছে মাতাল।
রূপ তার স্বর্গের যেন ছুয়েছে জোনাকির গা
থেমে থেমে ছন্দ বুনে তার সোনালী পা।
দুই চোখে প্রশান্তির ছায়া যেন আরব সাগর
পদ্মও নয় কমলও নয় কভু এমন ডাগর।
স্বাদ জাগে কোমল নাকে পরাতে সোনার লোলক
মায়া মাখা রূপ তার পড়ে না চোখের পলক।
ঠোট যেন মায়াবী গোলাপের স্নিগ্ধ কোমল পাপড়ি
অপলকে চোখে  চোখ রেখে মন নিয়েছে কাড়ি।
ও চোর, আমায় চুরি করে নাও, দাও পূর্ণতা
তোমায় পেলে পূর্ণ হবে আমার সব শূণ্যতা।
আদরে সোহাগে পুষব তোরে ওরে নিশুতির ফুল
দেখে তোরে স্বাদ জাগে করতে কিছু ভুল।
রূপ কুমারী স্বর্গের অপ্সরী জগৎ সেরা হেম
হৃদয়ের ডায়েরি লেখেছি তোর নামে, অনাধিকার প্রেম।


তার সনে প্রেম জমানোর অধিকার আমার ছিলো না। নাম জানতেও ছিলো বাধা। তাই আমি তারে অনাধিকার নাম দিলাম। এই নাম মনে পড়ে প্রতিটি রাতে, জোছনার সনে বসে জোনাকিকে শুনাই সেই কবিতা, অনাধিকার প্রেম। নর-রমনীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ হয় প্রতিটি ফুল শয্যা। আঁধারের বুক ছিঁড়ে অবনিতে ফুটে আলো, পবিত্র মিনারে বেঁজে উঠে সত্যের সেই সুর। থেমে যায় চোখের কথোপকথন।

প্রভাতে বন্ধুর সনে কিছু তিক্ত কথনের কারণে মনস্থির করি ফিরে আসার। পরক্ষণে মনে হলো,  বন্ধুত্বে যদি দাগ পড়ে যায়। অর্ধেক হেতু তা হলেও পূর্ণ কিন্তু নয়। অচেনা অপ্সরি কে আরেক বার অবলোকন করার স্বাধ, চোখে চোখে কিছু আলাপের বাসনা আমাকে ভুলিয়ে দেয় তিক্ত কথনের ক্ষোভ। অচেনা অজানা অনাধিকার রাজ্যে যদি একবার হয় পরিছয়।

দ্বি-প্রহরে বিয়ের লগ্নে সে আসে। একটু পরে ইতি হবে এই বিয়ের লগ্নের।  ফিরে যাবে সে। হয়তো দেখা হবে না আর। আমি ওর চোখের ভাষা বুঝি, সেও বুঝে। বন্ধুকে আমার নাম্বারটা তার কাছে পৌঁছে দিতে বলি। কিন্তু তা তার কাম্য নয়। সে চায় না অনাধিকার রাজ্যে আমার অধিকার হোক। সেওতো রাজা হতে চায়। মেয়েটি আমার চেনা নয়, আমি ও এ গাঁয়ের কেউ নই। যা টুকু চেনা, যা টুকু জানা সবই আমার বন্ধুর। তাই অধিকারও তার, বাকিটা অস্পষ্ট থাক। তাই আমি তারে অনাধিকার বলে সম্মোধন করছি। বন্ধুর এক আত্মীয়ের সাহায্য নিলে অনাধিকারের রাজ্যে আমার কিছু অধিকার হতো। কিন্তু বন্ধুর সম্মতির অভাবে তাও হলো না। সরাসরি কথা বলার, নামটি জানতে চাওয়ার পরিবেশ, সব মিলিয়ে এককথায় সেখানে ছিলো না। অনুভূতি গুলো প্রকাশ করা যায় না, প্রতিটি লেখকেরই ভান্ডারে আপন অনুভূতি প্রকাশের শব্দ খুবেই সীমিত। অনাধিকার রাজ্যে অধিকার নেওয়ার ইচ্ছা আমার মহুর্তেই উবে। যেখানে বন্ধু মান সম্মানের প্রশ্ন এসে যায়।  অনাধিকার মাঝে আমার অধিকার নেওয়ার ইচ্ছায় নাকি বন্ধু অবস্থান নষ্ট হচ্ছে। সম্মান ক্ষুন্ন হচ্ছে। প্রিয়ার প্রেমের চাইতে বন্ধুর সম্মান আমার কাছে বেশি গুরুত্ব বহন করে। যদিও এটা আমার কাছে স্পষ্ট নয়, একটি মেয়ের সাথে আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হলে ওর সম্মান কেন নষ্ট হবে?  ওকে কেন্দ্র করে বিয়েতে গেলেও মেয়েটি তার আত্মীয় নয়। বুক ভরা অভিমান মুছে দিলো সব প্রেম। খুব দ্রুত আমি বিয়ে বাড়ি ত্যাগ করি। ফেরার আগে অনাধিকার সামনে এসেছিলো কয়েকবার। ফিরে তাকাইনি সেদিকে। সেখানে থাকলে হয়তো ইচ্ছে হবে তার সাথে আলাপ করার। সেটা যতই মধুর হোক বন্ধুর সম্মানের প্রশ্নে তা তিক্ত। প্রেম আর বন্ধুত্ব যেখানে মুখামুখি, বন্ধুত্বের অবস্থান সেখানে শক্ত।

(সমাপ্ত)

-হাসান মাহমুদ বজ্র
ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।
মোবাইল
ই-মেইল- poetmmhasanmahmud556@gmail.com

Comments