মাসিক বজ্র || আগষ্ট-২০১৯ || ঈদুল আযহা || একাদশ সংখ্যা || ছোটগল্প

একজন পুলিশ ও সোহানের গল্প

 এম.ডি ইসমাঈল উদ্দিন নিশান।

 এক কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে নিজের রচিত আপন সুরে নিজের কন্ঠে রেকর্ড করা একটি সংগীত প্লে করে ঝিমচ্ছি। ঘুম আছে চোখে, হালকা হালকা। ডানপাশের জানালা খোলা আছে। মধ্যগতির সমীরে স্বস্তি পাচ্ছি। ভালো লাগছে। গত দুইমাস সেলুনের সাথে দেখা হয়নি। লম্বাটে শির কেশ দুলছে তালে তালে। আরাকান সড়কের দ্রুত যানে বসলাম। গন্তব্য চট্টগ্রাম। অন্য যানের চেয়ে এই কোম্পানির বাসে ঝাঁকুনি একটু বেশি। তার যৌক্তিক কারণ, বাসের গতি বেশি। অল্প সময়ে গন্তব্য পাড়ি দেয়ার বদৌলতে স্বল্প সময়ে মারছা এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। আমি তার নিয়মিত যাত্রী। তাৎক্ষণিক কোনো টিকেট এখানে পাওয়া যায় না। কোনো সময় না। অন্তত দুই বা ততোধিক ক্রমেই সিট পাওয়া যায়। এ বাসের এত যাত্রী।  অন্য বাসের খরাতেও এখানে যাত্রীর বন্যা থাকে। পাশের সিটে সোহান। সোহান আমার বাল্য বন্ধু। এখন একজন  দক্ষ, সুখ্যাত ও সততায় স্বর্ণপদক প্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। ও ঘুমোচ্ছে।

 চোখের আবছা ঘুম ঝাঁকুনির চোটে ভেঙ্গে যাচ্ছে, একটু বিরক্ত লাগছে। ভোর পাঁচটা তখন। নামাজটা শেষ করেই গাড়িতে চাপলাম মাত্র। সিটটা পেছনে আরেকটু হেলিয়ে চোখ দুটো বাইরে তাক করলাম। কানে সঙ্গীত বাজে। একটা আম গাছ দেখলাম রাস্তার পাশে। মন ছুটলো স্মৃতির পাতায়।

ছোটবেলার কথা। তারিখটা মনে নেই, শনিবার। সালটাও খেয়ালে আসছে না। ৬ষ্ঠতে পড়ছি। কৈশোরে চলছে জীবন গাড়ি। দস্যিপনা ছিলো নিত্য সঙ্গী। সারা গাঁ চষে বেড়াতাম। গাঁয়ের ধার ঘেষে চলেছে আরাকান সড়ক। বাড়ি থেকে এক মিনিট হাঁটলেই তার দেখা মিলে। আমার গাঁয়ের এলাকাতে সড়ক ধারে মাঝারি এক আমগাছ। কোনো পরিচর্যা ছাড়াই প্রতিবছর প্রচুর আম ধরে। যা আমার মতো দস্যিদের খোরাক। একটু টক হতে না হতেই গাছে পাতলা। আমের দিনে মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের ঘাটি ঐ আমতল। তাই পুলিশ আসার আগে আমাদের অপারেশন চলে সাপ্তাহে দুয়েকবার- যতদিন ফুরোয় নি। পুলিশ আম পাড়ার অপারেশন বিরোধী। তাই একদিন আম পাড়ার অপরাধে একজনকে গাড়িতে করে ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো। সেই থেকে পুলিশকে ভয় পায় সবাই।

একদিন সোহান গাছে ওঠে আম পারছে আর আমি নিচে কুড়াচ্ছি। এমন সময় হঠাৎ পুলিশের গাড়ি উপস্থিত। আমি দেখে কিছু ভাবার আগেই আমের গোছ নিয়ে দিলাম এক বুলেট দৌড়। সোহানের কি হবে ভাবার টাইম নাই, নিজে বাঁচলে বাপের নাম। তখন সোহানের হাতে কয়েকটা আম ছিলো- যা নিচে ফেলবে, কিন্তু পুলিশ আসাতে আর পারলো না। আমি একশো মিটার আনুমানিক দৌড়ালাম, তারপর থেমে হাঁপাচ্ছি। 

মিনিট পনেরো পর পিঠে দু-চার কিল ঘুষি পড়লো। পিছনে তাকিয়ে দেখি সোহান। রাগের চেয়ে অবাক বেশি হলাম। বিস্মিতভাবে বললাম- ক্যামনে এলি?
--- তুই বলদ আমাকে বলস নাই যে পুলিশ এসেছে। 
--- তো?
--- তো আর কি? হাতে আম চারটা নিলাম, তোকে জিঙ্গেস করলাম আম কয়টা হলো?
একজন পুলিশ বললো- তুমি আগে নামো,  তারপর বলছি। আমি তো ভয়ে শেষ৷ হাতটা কেঁপে ওঠলো, আমগুলোও পড়ে গেলো। আমি ভয়ার্ত চোখ নিয়ে আস্তে আস্তে নামলাম। ইয়া বর পেটওয়ালা পুলিশটা কান ধরে টান দিলেন। আর বললেন- আম পারতে নিষেধ করেছিলাম। শুনো নি?
--- আর পারবো না কখনো। আমাকে ছেড়ে দিন। তাতে হলো না, আমাকে গাড়িতে তুলে বললো আজ তোমার খবর আছে। আমার খুব ভয় করছে তখন। আমি একটা বুদ্ধি করলাম, বললাম-
---আমার ভয় করছে, আমি হিসু করবো।
--- গাড়ি থেকে নেমে করো। আজকে তোমার ছাড় নাই। আরেকজন বললেন।
আমি নামলাম, একটু দুরে গিয়ে প্যান্টের চেইন খুলে   ......... টা বের করলাম। পিছনে ফিরে দেখি তাঁরা একটি বোঝাই ট্রাক আটকাচ্ছেন।  এই সময়ের জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। ঠিক সে সময় এক দৌড়ে চলে এলাম।
--- তোর হিসু?
--- এটা তো বোকা বানাইছি। আমার কোনো হিসো-টিসো পায়নি।
আমি তার প্যান্ট দেখি তখনো খোলা, বললাম- চেইন বাঁন্ধ।
দু জনেই হু হু করে হেসে ওঠলাম। আমার নিয়ে আসা আমগুলো গুনলাম, আটারোটি। সোহানকে ১০টি আর আমি ৮ টি নিলাম। কথা ছিল সমান সমান। কিন্তু আমি তাকে ২টি বেশি দিয়েছি।

পরেরদিন বুদ্ধি করে তাদের জন্য একটা মাঝারি আকারের মধ্যপাকা কাঁঠাল নিয়ে গেলাম। বললাম এটা আমরা আপনাদের জন্য এনেছি।
---- খাবো কিভাবে,? শক্ত।
--- এইতো দা এনেছি।
--- কোত্থেকে এনেছো? চুরি করে?
--- না, আমাদের গাছের। মাকে বলে এনেছি।
--- আচ্ছা, ধন্যবাদ।
একজন কাঁঠালটা কাটলো। কোষগুলো খুব রসালো ছিলো। আমাদেরকে খেতে বললেন। আমরা খেতে রাজি হয়নি। তখন সুন্দর পুলিশটা বললেন- নিশ্চয় চুরি করেছো, না হলে তোমরা খাচ্ছো না ক্যান? আমি বললাম- খাবো। সবাই মজা করে খেলাম। খাওয়া শেষ।
সুন্দর, লম্বা পুলিশের হাতে আঁঠা লাগলো। বললেন- এখন কি দিয়ে ধোই?
--- সরিষা তেল মেখে মুছে ফেললে চলে যাবে।
--- বাহ্, তুমি তো অনেক কিছু জানো।

তিনি আমার নাম জিঙ্গেস করলেন, সোহানেরও। আমাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়ে বললেন এটা রাখো। তোমরা নাস্তা খেয়ো। আমি নিতে নারাজ হলাম। সোহানও নিলো না। বললাম- এটা তো আপনাদের জন্য এনেছি। টাকা নিবো কেনো? আম্মু বলেন- খুশি মনে কাউকে কিছু দিয়ে বিনিময় নিতে নেই। ওনার বুকে একটা নাম লেখা- ইক্বরাম। সম্ভবত এটা ওনার নাম। বললাম- আপনার নাম কি ইক্বরাম?
--- হুম, আমি ইক্বরাম। তুমি ক্যামনে জানলে?
--- ঐ যে, আপনার বুকে লেখা আছে।
--- বাহ্, তুমি তো চালাকও বটে। আচ্ছা টাকাটা রাখো। এটা অগ্রিম দিলাম। কাল আরেকটা কাঁঠাল আনো।
--- না, না। কালও টাকা ছাড়া আনবো।
--- সব সময় টাকা ছাড়া নেয়া ভালো নয়। আম্মু বলেন- কেউ দিতে চাইলেও বিনা বিনিময়ে দ্বিতীয় বার কিছু গ্রহণ করা উচিত নয়।
--- তাহলে মাঝেমধ্যে আম পারতে দিলে হবে। আপনাদেরকেও দিবো।
--- বুঝলাম এতক্ষণ পর। আম খাওয়ার জন্যই আম্মুকে ফুসলিয়ে কাঁঠাল এনেছো। 
কথা শুনে সবাই গাল পুরওয়ে হাসি দিলেন। আমি আর সোহানও।

কয়েকদিন নিয়মিত গেলাম, আমও খেলাম গল্পও হলো। একদিন আমি বললাম- পুলিশকে আমার খুব ভয় লাগতো আগে। তিনি বললেন-
পুলিশকে ভয় পাবে না, পুলিশকে কখনো মিথ্যে বলবে না, কখনো ভুল তথ্য দিবেনা। পুলিশ সবার বন্ধু। এই যে এখন পুলিশ তোমাদের বন্ধু, তেমনি সবারও। অন্যের ক্ষতি করবে না, দেশের ক্ষতি করবে না। খারাপ কাজ করবে না। বড় হয়ে খারাপ দেখলেই পুলিশকে জানাবে। তাদের সাথে মিশবে না, তাদের ভালোবাসবে না। সমাজের ভালোর দিক চিন্তা করবে। অন্যের উপকার করবে। ক্ষতি করবে না। যারা ভালো কাজ করে তারা মরে গেলেও মানুষ তাদেরকে সম্মানের সাথে স্মরণ করে। যেমন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা। আর যারা খারাপ কাজ করে তারা অপরাধী। তাদেরকে আাসামি বলে। মানুষ তাদেরকে ঘৃনা করে। এরকম মানুষগুলো সমাজে না থাকলে একদিন দেশ সত্যি সত্যি সোনার দেশ হবে।

সোহান বললো-তাহলে বড় হয়ে আমি আদর্শ পুলিশ হবো। আসামিদের নির্মূল করবো। ইক্বরাম সাহেব আমাকে বললেন- নিশান, তুমি কি হবে?
--- স্যার, আমি সোহানের ধরা আসামিদের বিচার করবো। কঠিন শাস্তি দেবো।
--- বাহ্, তার মানে তুমি বিচারপতি হবে?
--- হুম, ইনশাহ্ আল্লাহ্।


সেই অনুপ্রেরণায় এখন সোহান একজন সৎ পুলিশ অফিসার। কিন্তু আমার আর বিচারপতি হয়ে ওঠা হলো না। তবে বিচার করি। আসামির না, বৃদ্ধ অচল বাবার সংসারের হাল ধরে তার অভাবগুলোর। আমার হালকা আয়ে চলে আমাদের অভাবের সংসার। এসব ভাবতে ভাবতে মনের অজান্তে কখন যে চোখ সাগরে বন্যা এলো খেয়াল নেই। ততক্ষণে গাড়ি সকালের নাস্তা বিরতি দিয়েছে। সবাই একজন একজন করে নেমে গেলো। সোহান বললো- চল্, চা পান করে আসি। এ বলে সেও নেমে গেলো। হয়তো আমার চোখ খেয়াল করেনি। দেখলে আবার কৈফিয়ত চাইতো। আমি চোখ দুটি মুছে মুখ ধুতে গেলাম।

Comments