ছোটগল্প- শিল্পী || মাসিক বজ্র || ৭ম সংখ্যা || এপ্রিল- ২০১৯
শিল্পী
-লুবনা আখতার বানু
শিল্পীর ছোট্ট গৃহে মাত্র ছয়জন লোকের বসবাস।ঠাকুমা,মা,বাবা ও ছোট ছোট আরো দুটি বোন।ঠাকুরদা জীবিত আছেন বলেই অনেকের ধারনা।তিনি শিল্পীর বাবা অর্থাৎ সৌমেনবাবুর জন্মের পরই রোজগারের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়েছিলেন।আর তারপর চলে গেছে দীর্ঘ পঁচিশটি বছর।এই পঁচিশ বছরে সৌমেনবাবুর বাবা একটি বারের জন্যও স্ত্রী ও পুত্রের কোন খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি।সৌমেনবাবুর মায়ের ধারনা তিনি বিদেশে আবার সংসার পেতেছেন।
সরলাদেবী অর্থাৎ সৌমেনবাবুর মা অনেক কষ্টে লোকের গৃহে কাজ করে তাঁর সংসার কোন রকমে চালাতে থাকেন।অতিকষ্টে এভাবেই কাটতে থাকে সরলাদেবীর দিনগুলি।ছেলেকে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করালেও তাকে শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে নি তাঁর পক্ষে।ছেলে একটু বড়ো হতেই একটি হোটেলে রান্নার কাজ করতে শুরু করলেন।আর বছর তিন যেতে না যেতেই মা ও ছেলে মিলে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান করলেন।চা ছাড়াও সেখানে পাওয়া যেত পান,বিস্কিট,চাল,ডাল ইত্যাদি টুকিটাকি।এতোদিনে সরলাদেবীর দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব হল।এখন তাঁকে আর লোকের গৃহে কাজ করতে যেতে হয় না।সারাদিন নিজের দোকানে বসেই তাঁর দিন কেটে যায়।
আরো মাস কয়েক যেতেই তিনি তাঁর ছেলের বিবাহ দিলেন।পুত্র বধূও পেলেন ঠিক তাঁর মনের মতোই।সুখেই কাটছিলো তাদের দিনগুলি।বছর কাটতে না কাটতেই সরলাদেবী পেলেন নাতনী শিল্পীকে।গোটা গৃহে যেন এলো এক আনন্দলহরী।এভাবে অভাব অনটনের মধ্যেও তাঁদের দিনগুলি যেনো স্বপ্নের মতোই কাটছিলো।সকলের ভীষণ আদরের শিল্পীও ধীরে ধীরে বড়ো হতে লাগলো।শিল্পীর বয়স চার হতেই তাকে শিক্ষা অর্জনের জন্য গৃহের নিকটেই একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেওয়া হলো।
আর্থিক স্বচ্ছলতা বর্তমানে বদলে দিয়েছে সৌমেনবাবুকে।তিনি নিজেকে পালটে ফেলতে এতটুকু সময় নষ্ট করেন নি।বর্তমানে রোজরাতে নেশা করে গৃহে ফেরা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে।সরলাদেবীর সুখের সংসার এভাবেই অন্ধকারে ছেয়ে যেতে লাগলো দিনের পর দিন আরো একবার।বহু কষ্টে দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে সরলাদেবী তিলে তিলে যে সুন্দর ফুলের বাগান সাজিয়েছিলেন,তা যেন নিমেষেই নষ্ট হতে থাকে।স্ত্রী লক্ষ্মী সেই কুপথ থেকে স্বামীকে ফেরাতে চেষ্টা করলে তাঁর কপালে জুটতো বেত্রাঘাত ও লাথি।এভাবে দিন কাটানো ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠলো তাদের পক্ষে।এভাবে অতি যন্ত্রনার মধ্যেই লক্ষ্মী প্রসব করলেন আরো দুটি কন্যা সন্তান।
দিন কাটতে লাগলো আর সংসারের খরচও বাড়তে লাগলো।সৌমেনবাবু যা রোজগার করেন,তার সবটাই কুপথে ব্যবহৃত হয়।দোকান থেকে যতটা রোজগার হয় তাতে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়লো সরলাদেবীর পক্ষে।শিল্পীর শিক্ষার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের।বোন পূজা ও আরতিও ক্রমশই বড়ো হয়ে উঠতে লাগলো।সরলাদেবী হতাশ হয়ে পড়লেন।তবে কি আদরের শিল্পীকেও শিক্ষিত করে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না!এই সমস্ত চিন্তা ভাবনাই দিনের পর দিন বয়সের সাথে সাথে সরলাদেবীকে শয্যাশায়ী করে তোলে।ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।লক্ষ্মীদেবীও বড়োই অসহায় হয়ে পড়েন।এরই মধ্যে নেশা ধীরে ধীরে সৌমেনবাবুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।অত্যাধিক পরিমান নেশার কারনে কিছুদিনের মধ্যেই সৌমেনবাবুর মৃত্যু ঘটে।
সৌমেনবাবুর মৃত্যু,ঠাকুমার অসুস্থতা ও মায়ের অসহায়তা মাত্র দশম শ্রেনীর শিল্পীকে সংসারে যেন অনেক দায়িত্বশীল করে তোলে।ইচ্ছে না থাকলেও ছাড়তে হয় তাকে তার বিদ্যালয় জীবন।আর অংশ নিতে হয় সংসারে একজন পুরুষের ভূমিকায়।দোকান ও টিউশন করে তাকে এই কম বয়সেই ধরতে হয় সংসারের হাল।শিল্পী প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক না কেন,তার ঠাকুমার অতি কষ্টে গড়ে তোলা সংসারে সে আবারো শান্তি ও স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে।যেভাবেই হোক না কেন তার ছোট্ট বোন দুটোকে সে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবে।সে আরো প্রতিজ্ঞা করে যে সে তার অসহায় মায়ের পাশে শক্তি হয়ে দাঁড়াবেই।
এভাবেই শুরু হয় শিল্পীর জীবনের এক নতুন অধ্যায়।দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করেই চলতে থাকে শিল্পীর জীবন।গোটা পরিবারকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে কোন কোন দিন নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত থাকে না শিল্পীর।যথাসময়ে দোকানে বসা,টিউশন করা ও বোনেদের বিদ্যালয়ে দিয়ে আসা ও নিয়ে আসাতেই কেটে যায় তার সবটা সময়।ছোট্ট বোন দুটোর মিষ্টি হাসি রাতে শিল্পীকে ভুলিয়ে দিতো তার সারাদিনের কঠোর পরিশ্রমকে।আর তাকে পুনরায় প্রস্তুত করে তুলতো আগামী দিনের জীবন যুদ্ধের জন্য।এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর সময়।নিত্যদিনের অভ্যাসে সময়ও দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে একই নিয়মে।এভাবে কেটে যায় আরো ত্রিশটি বছর।
আজ আরো ত্রিশ বছর পর শিল্পীর ছোট্ট গৃহে মাত্র দুজন লোকের বসবাস।শুধুমাত্র শিল্পী ও তার মা আজ এই গৃহে থাকেন।এরই মধ্যে সরলাদেবীও আজ আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই।শিল্পীর ছোট্ট মিষ্টি বোন দুটিও আজ অনেক বড়ো হয়ে উঠেছে।শিল্পী তাদের নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলতে পেরেছে।তারা আজ খুব ভালো মনের মানুষ, উচ্চশিক্ষিতা ও চাকুরীজীবিও বটে।তাদের বিয়েও হয়ে গেছে।শিল্পীর গৃহ থেকে বোনেদের শ্বশুরবাড়ীর দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়।বোনেরা আপদে-বিপদে মা ও দিদির খোঁজ নিতে আসে সর্বদাই।তারা আজও শ্রদ্ধা করে মা ও দিদিকে ঈশ্বররূপে।আমাদের সকলের প্রিয় শিল্পীর অবশ্য সব দায়িত্ব ও কর্তব্য সামলে নিজের সংসার আর গুছিয়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠে নি।আর তাই আজও সে অবিবাহিতা।কিন্তু তবুও ভীষণ আনন্দিত আজ সে।আমাদের সেই ছোট্ট শিল্পী আজ সমাজের চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতে পেরেছে যে,চাইলে মেয়েরাও পারে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ বিসর্জন দিয়ে নিজের আদরের পরিবারকে মাতৃস্নেহ ও পিতৃস্নেহে আগলে রাখতে।
সমাপ্ত।
Comments
Post a Comment