ছোটগল্প- মায়ের স্বপ্ন ||মাসিক বজ্র || ৭ম সংখ্যা || এপ্রিল- ২০১৯

মায়ের স্বপ্ন

আনোয়ার সুফিয়ান 


মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙলো তানছিরের। পাখি ডাকা ভোর। মৃদু-মন্দ বাতাস। কিন্তু ওর মনটা বেশি ভালো নেই। দশম শ্রেণিতে পড়ে। পড়া পারে না ক্লাসে একদিনও। প্রতিদিন অন্যান্য শিক্ষার্থীরা যেখানে পায় ভেরি গুড, গুড সেখানে ওর কপালে জুটে শিক্ষকের রাগ ও অসহনীয় বেত্রাঘাত। এগুলো ভাবতে আজ হঠাৎ ওর অনেকটা খারাপ লাগছে। মনটা ভার করে বসে থাকে পুকুর পাড়ের বিশাল কাঁঠাল গাছের শিকড়ের উপর। হাতে একটা ক্ষুদ্র কাঠি নিয়ে তার ক্ষুদ্র রাগ অভিমানগুলো প্রকাশ করে মাটিতে আঁকিবুকি করে। মা ওর পাশে এসে দাঁড়ান। হাত রাখেন কাঁধে। বলেন, '' তানছির, তোকে নিয়ে আমার অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন, অনেক ভালোবাসা। তোর বাবা নাই। শিক্ষিত হয়ে পরিবারের হাল ধরতে হবে তোকেই। ''
মা, আমি কি শিক্ষা অর্জন করতে পারবো?তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবো? মায়ের দুচোখে দেখা দেয় বিস্ময়ের চিহ্ন। '' কেন পারবি না? মানুষ ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই পারে। তুইও পারবি। তোকে পারতে হবে। এমন কিছু করবি যাতে অবাক হয়ে যায় সমাজের মানুষ। '' তানছির মনের ভিতর করে বসে এক দৃঢ় শপথ, '' আমি পড়াশোনা করবো, একদিন প্রতিষ্ঠিত হবো, মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবো। ''
এখন তানছিরের দুচোখে খেলা করে নতুন স্বপ্ন। আর নয় পিছিয়ে থাকা। এখন শুধু সামনে এগিয়ে যাওয়া। ওর ডাগর ডাগর চোখে এখন শুধুই বড় হওয়ার উপচে পড়া ঢেউ।

প্রতিদিনের চেয়ে তানছির আজ আলাদা। পাল্টে গেছে ওর রুটিন। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলো। ফজরের নামাজ পড়েই পড়তে বসলো ক্লাসের বই নিয়ে। পড়ায় বেশ মনোযোগ আজ ওর। একদিনও এভাবে পড়েনি ও। মায়ের কথামত তানছির গোসল করে নেয়। খেয়ে-দেয়ে স্কুলে যায়। আজ তানছির বসতে চাইলো ফার্স্ট সিটে। বাঁধা দিল প্রতিম আর হৃদয়। ওরা মুখ ভেঙছিয়ে বলে, ''শালা, একদিনও পড়া পারে না। আবার বসতে চায় ফার্স্ট সিটে। গাঁধা কোথাকার, যা পিছে যা। '' নিরুপায় তানছির ধীরে ধীরে গিয়ে বসলো লাস্ট সিটে। কিছুক্ষণ মন ভারী করে বসে রইলো কিন্তু মনে এক অজানা আনন্দ ওর। হঠাৎ ক্লাসে হাসান স্যারের প্রবেশ।
--- আসসালামু আলাইকুম স্যার। সবাই উঠে দাঁড়ালো।
--- ওয়ালাইকুম সালাম। বসো সবাই। নাম ডাকা শেষে এবার পড়া ধরার পালা।
--- কার কার পড়া হয়নি দাঁড়িয়ে যাও। অনেকে দাঁড়ালো। কিন্তু দৈনিক কাস্টমার তানছির বসে রইলো।
--- আবার বলছি কার পড়া হয়নি দাঁড়াও। (তানছিরের দিকে তাকিয়ে)
--- তানছির স্বগর্বে উঠে দাঁড়ালো
--- কি তানছির? এতক্ষণ দাঁড়ালে না কেন?
--- না, স্যার। মানে আমার পড়া হয়েছে। আমি বলতে পড়বো। আমি আজ আগে পড়া বলবো।
---- কথাগুলো স্যারের কানে নতুন মনে হলো। এমন কথা তানছিরের মুখে আজ প্রথম শুনলেন তো, তাই।
---- বলো দেখি, কি পড়লে।
--- এক নিঃশ্বাসে ও গড় গড় করে পড়া বলে দেয়। মুখ থেকে যেন বুলেট বের হচ্ছে।
স্যার বিস্ময়ে তাকান ওর দিকে। রীতিমত অবাক হয়ে যান। আর সহপাঠিরা ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। প্রতিম আর হৃদয় লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তানছির এখন পড়াশোনা করছে পুরোদমে। ও আদা জল খেয়ে লেগেছে। রেজাল্ট ওকে ভালো করতেই হবে। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে।
কিছুদিন পর ঘনিয়ে এলো তানছিরের এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষার কেন্দ্র পড়লো ওর আনোয়ারা খালাদের বাড়ির পাশে। তাই মনে করলো খালার বাড়ি থেকে পরীক্ষা দিবে। মা বলেন, '' যা বাবা, তোর জন্য দোয়া করি। ভাল মত পরীক্ষা দিস।''
মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তানছির খালার বাড়ি চলে গেলো। এদিকে পরের দিন থেকেই মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি যেন উঠে বসতেই পারছেননা। তানছিরের পরীক্ষার কথা চিন্তা করে ওকে না বলে আনোয়ারা খালা বোনকে দেখতে আসেন। তানছির ভালো করে পরীক্ষা দিচ্ছে। শেষ পরীক্ষার দিন তার দেখা হয় বন্ধু পারভেজের সাথে। পরীক্ষা শেষে পারভেজ বলে, ''তানছির, তোর মা খুব অসুস্থ। দেখতে যাবি না? ''
প্রথমে তানছির বাকরুদ্ধ হয়।পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়িতে যায়। মায়ের রোগাক্রান্ত ভাজ পড়া শুকনা মলিন ঠোঁটে একরাশ হাসি ফুটলো। তিনি ছেলের হাতটি চেপে ধরে বললেন, ''তানছির, বাজান আমার। এটাই আমার জীবনের শেষ প্রহর। চির বিদায়ের সুচনা বেলা। তুই ভালো করে পড়াশোনা করিস। অসহায় মানুষের জন্য কিছু করিস। জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোস।তবেই আমি শান্তি পাবো। ''
মা ছেলের মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলালেন। ছেলের মুখটা কাছে টেনে নিয়ে ওর চাঁদ কপালে একটা চুমু খেলেন। বিদায়ের দিনে ছেলেকে এটা ছাড়া দেওয়ার মত কিছুই ছিল মা জননির কাছে। তানছির লক্ষ্য করলো ওর মায়ের চোখ দুটি বুজে যাচ্ছে। এ বুজা যে চিরদিনের বুজা তা বুঝতে দেড়ি হলো না তানছিরের। ক্ষাণিক্ষণ পর মায়ের দেহটা লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।''মাগো'' বলে এক চিৎকারে জ্ঞান হারায় তানছির। পৃথিবীর একমাত্র আপন মানুষটি চলে গেছে চির জনমের জন্য।
তানছিরের দিনগুলো আর কাটতে চায় না। ওর একটুও বিশ্বাস হচ্ছে না যে মা এভাবে চলে যাবেন।এভাবেই কাটতে থাকে তানছিরের রেজাল্ট পাবার প্রতীক্ষিত নিঃস্বঙ্গ জীবন ।একদিন সত্যি সে রেজাল্টের কথা জানতে পারে। স্কুলের প্রিন্সিপাল তানছিরের বাড়িতে যান। ওর হাতে একটা পত্রিকা দেন। পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় মোটা করে লেখা, '' মায়ের স্বপ্ন পূরণ করেছে তানছির। ''এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছে সে। এত সুন্দর রেজাল্ট ! অথচ ওর মনে নেই একটু বিন্দুমাত্র আনন্দ। কি করে থাকবে। ওর সব আনন্দ যে তলিয়ে গেছে মাটির গর্ভে। সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে ওর আনন্দগুলো নিশ্চুপে নিরালয়ে নির্বিকার হয়ে আছে। সে পত্রিকাটি হাতে মায়ের কবরের কাছে গেল। চিৎকার করে বলল, '' মাগো, ও আমার গর্ভধারিণী মা। তুমি আজ শুয়ে আছো মাটির ঘরে। বাঁশের শিকলে ঘেরা অন্ধকার কারাগারে। মা, মাগো, ও মা। কথা কও মা। মাগো, দেখ মা। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। আমি প্রথম হয়েছি মা প্রথম হয়েছি। ''ইতিমধ্যে শুভ, শান্ত, রিমু, আলামিন, আলিফ, রুপম সবাই প্রিয় বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানাতে এলো। সবাই যেন শুনতে পেলো কবর থেকে তানছিরের মা বললেন, ''বাজান আমার, তোর প্রতি রইলো আমার আশীর্বাদ। ''

লেখক- আনোয়ার সুফিয়ান
ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ।


Comments

  1. আমার লেখাটি প্রকাশের জন্য সম্পাদক ভাইকে ধন্যবাদ ।

    ReplyDelete

Post a Comment