ছোটগল্প- চেষ্টার ফল || মাসিক বজ্র || ৭ম সংখ্যা || এপ্রিল- ২০১৯




চেষ্টার ফল

হেদায়েত উল্লাহ


অজপাড়াগাঁয়ের ছেলে মফিজুর রহমান। পড়ালেখা তেমন বেশি করেনি। তবে দীর্ঘ দিন অবধি শহরে উন্নতমানের একটি সার ফ্যাক্টরিতে চাকরি করায় শিক্ষিত ছেলেদের মত ভদ্র অমায়িক। কেননা তার সহকর্মীরা অধিকাংশ ছিল নাম করা কলেজ ভার্সিটি থেকে পাশ করা মেধাবী স্টুডেন্ট। তাদের থেকে সে লেখাপড়ার কতই না কথা শুনছে প্রতিনিয়তই। তার সহকর্মীরা আড্ডায় বসলে প্রায় সময় আফজল স্যারের কথা বলত।

অফজল সাহেব স্যারের কথা আলোচনায় আসার যৌক্তিক কারণ ও আছে। আফজল স্যার ছিলেন তাদের শৈশবে পড়ে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার। সে ৩৬ তম বিসিএসে ৩৬ তম স্থান দখল করেছিলেন। ফলে তার কপালে হেডমাস্টার জুড়ে যায়।

মফিজের বন্ধুরা সবসময় তাদের স্যারের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলত। তারা তাকে নিয়ে গর্ব করত। তার অধ্যায়ন ছিল জিনের ছেলেদের মত। পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার স্বভাবটা তার মধ্যে কোন দিনেও প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। সে খুব প্রখর মেধার অধিকারী ও ছিল। তবে তার ছেলে আদনান ছিল তার পুরাটায় বিপরীত। আফজল স্যার যে পথে চলেছে ঠিক সেই পথের বিপরীত দিকেই তার ছেলে আদনানের পথচলা। আদনান ছিল ৫ম শ্রেণির ছাত্র। সে  ক্লাসের লাস্ট বয়। একদিকে দুষ্টু আবার পড়ালেখায় ও তেমন ভাল না। সবাই তাকে তার নাম ধরে না ডেকে গাদা নামে ডেকে থাকে। গাদা বিশেষণটাই তার জন্য উপযুক্ত মনে হয়। একটি ক্লাস দুই বছর করে পড়ার পরও পাশের নাম্বার তুলতে পারেনা অনেক সময়।

এই সব গল্প শুনতে শুনতে অজপাড়াগাঁয়ের মফিজের কান ভারি হয়ে গেছে। মুফিজ সবেমাত্র বিবাহ করা একজন যুবক। সে নিয়মিত নামায ও দুআ পড়ে আল্লাহর কাছে মেধাবী আফজল স্যারের মত একজন পুত্র সন্তানের দরখাস্ত প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযে পাঁচ বার করেই যাচ্ছে। আল্লাহর মেহেরবানিতে কিছুকাল পর তার একটা পুত্র সন্তান জন্ম হলো। সে অনেক খুশি। সাত দিনের মাথায় আকিকার নামে এলাহি কান্ড করে। পাড়াপড়শি সবাই দাওয়াত দিয়ে পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। মসজিদের ইমাম সাহেব সহ আরো দশজন ছোট ইয়াতিম শিশুদের ও খাবার ব্যবস্থা করেছিল সে। মফিজ প্রতি রাতে ঘুমার আগে তার জাদুটাকে কোলে নিয়ে কতশত স্বপ্ন যে বুনে তার কোন ইয়ত্তা নেই। সে যখনই তার আদরের জাদুটাকে কোলে নেই তখনই তার সহকর্মীদের কথা মনে মনে ভাবতে থাকে। আর আল্লাহর কাছে দুআ করে তার জাদুটা যেন বড় হয়ে আফজল স্যারের মত হয়।

ছয় বছর পেরিয়ে গেলে। ছেলেটা বড় হওয়ার সাথে সাথে তার স্বপ্নটাও দিন দিন ছেলেটার মত বড় হতে লাগল। নার্সারিতে তার ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিল সে। আনন্দের সাথে নিয়মিত তার ছেলেটাকে স্কুলে আনা নেওয়া ও করতে লাগল। তার পড়া লেখার জন্য কতই না আয়োজন তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যারা সচক্ষে দেখেনি তারা তা বুঝতে পারা ও মুশকিল হবে। বাসায়ও একজন টিউটর রেখে তাকে বর্ণ পরিচয় করার চেষ্টা ও করছে সে। কিন্তু তার ছোলেটা এ্যাঁ বলতে বললে ইঁয়েঁ বলে। বি বলতে বললে মি বলে মুখ বাঁকা করে। মফিজের চিন্তার ইয়ত্তা নেই। সে তার সাত বছরের লালিত স্বপ্ন উল্টা পথে চলতে দেখছে। সে তার স্বপ্নের উল্টা হবে বলে ধারণা করে মনে মনে সদা চিন্তার রাজ্য সফর করতে থাকে। সে সবসময় দুআ করেছিল আফজল স্যারের মত একজন ছেলে হতে। এখন দেখে যাচ্ছে ছেলেটা আফজল স্যারের মত না হয়ে আফজল স্যারের ছেলে করিমের মত হল। এক এক ক্লাস দুই তিন বছর পড়েও পাশের লিস্টে তার নামটা তুলতে পারেনা। মফিজের ছেলের নাম ছিল নূরুল কবীর। সবাই থাকে নূরু নলে ডাকত। প্রতি দিন ক্লাসে মার বকা ইত্যাদি খেতে খেতে পড়ার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েছে।

তার এক বন্ধু ছিল ইসমাইল। সেও পড়ালেখায় প্রায় মফিজের ছেলে নূরুর মত। তবে তার একটা গুন হলো সে যে কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে। সে ভাবুক টাইপের ছেলে। সদা তার মাকে  হাজার রকমের প্রশ্ন করেই চলে। তার মা তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে হয়রান। মা অনেক সময় তাকে বকা দিয়ে বলে "তুই আগে তুর পড়া শেষ কর,পরে এই সব বিষয়ে চিন্তা করিস"। ক্লাসে মুফিজের ছেলে নূরু আর নূরুর বন্ধু ইসমাইল সবসময় শেষ বেঞ্চে বসে আড্ডা মারে।

 এখন তারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আগে মফিজের ছেলেটা মফিজের মত শান্ত টাইপের থাকলেও এখন তার বন্ধুর ইসমাইলের সাথে মিশে অনেকটা দুষ্টু হয়ে গেছে। আগের মত এখন বইতে ভুলেও হাত রাখে না। সদা তুলার একটা বল ও কাঠের হাতখানিক লম্বা একটা লাঠি নিয়ে মাঠে ময়দার ঘুরে বেড়ায়। একদিন স্যার ক্লাসে ইংরেজি রচনা মূখস্ত করতে বললে তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মত মনে হয়।

 তাদের ইংরেজি পড়াতেন শফিক স্যার। তিনি খুব রাগী ছিলেন। তাকে স্কুলের সবাই অনেক বেশি ভয় পেত। তার ক্লাস কেউ ফাঁকি দেওয়ার কথা চিন্তা করত না সহজে। তিনি সবার থেকে পড়া হাজিরা নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতে তিনি  সফল ও হয়েছেন। পরের দিন ক্লাসে আসলে শফিক স্যারের লাল চোখ আর কড়া ভাষায় কথা শুনে তারা ভয়ে কাতর। হাজিরা নেওয়া শুরু হলো। স্যার লম্বা একটা বেত দিয়ে ইচ্ছে মত মারতে লাগল। যারা পড়া পারে তাদের উৎসাহ দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আর যারা পড়া পারে না তাদের বেদম প্রহার করতে লাগল। সবার থেকে হাজিরা নেওয়ার পর স্যার আবার আগামীকাল ও একই রচনাটি মূখস্ত খাতায় লিখে নিবে বলে ওয়াদা করে ক্লাসের ইতি টানল।

সাথে সাথে এটাও ঘোষণা করে দিল যে আগামীকাল আজকের চেয়ে দুই তিন গুন বেশি মারা হবে। সবাই স্যারের কথা শুনে ভয়ে কাঁপতে লাগল। এই ফাঁকে নূরু ও তার বন্ধু ইসমাইল পরামর্শ করল যে তারা উভয়ে আগামীকাল আর স্কুলে আসবে না। পরের দিন তারা স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলার মাঠে ছুটি হওয়া পর্যন্ত গল্প করে কেটে দেয়। স্কুল ছুটে হলে হাত মুখ ধোয়ে তাদের অনন্য সহপাঠীদের সাথে বাড়ি ফিরে।

পরের দিন স্কুলে গেলে স্যার তাদের বেদম মারধর করেন। আবার আগামীকাল তাদের থেকে একই রচনাটা হাজিরা নিবে বলে স্যার রাগ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে যায়। 
স্যারের একটা স্বভাব ছিল যে পড়া আদায় না করে সামনে যেতেন না। স্যারের কাছে দুষ্টুমির জন্য ছাড় পেলেও পড়া না শেখার অপরাধের ছাড় পাওয়া যেত না। তাই তারা চিন্তা করল আগামীকাল থেকে আর ক্লাসে আসবে না। তারা পালিয়ে যাবে কোন অজানা ঠিকানায়। 

সেই উদ্দেশ্য সকাল সকাল বাড়ি থেকে স্কুলে যাওয়ার কথা বলে বের হয়ে নূরুর বন্ধু ইসমাইল সহ পাহাড়ের দিকে ছুটে যায়। তারা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে একটি উঁচু পাহাড়ের নিচে সমতল ছোট একটা জায়গায় বসে গেল। স্কুলে টিফিন করার জন্য যে নাস্তা মা নূরুর ব্যাগে ভরে দিয়েছিল তা বের করে দুজন বন্ধু মিলে খেতে আরম্ভ করল। খেতে খেতে হঠাৎ নুরুর চোখ পড়ে পাহাড়ের চূড়ার দিকে। যেখানে একটা পিপড়া চূড়ায় উঠার চেষ্টা করছিল আর ব্যর্থ হচ্ছিল। তা দেখে নুরু তার বন্ধু ইসমাইলকে বলে বন্ধু একটি পিপড়ার কান্ড দেখ। সে কি করতেছে। সেই পিপড়া তাদের চোখের সামনে অনেক বার ব্যর্থ হওয়ার পর চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছিল। তা দেখে তাদের মনে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মত একটা কৌতূহল এসে হাজির হল। সে তার বন্ধু ইসমাইলকে বলতে লাগল  দুস্ত! এই পিপড়াকে দেখে অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের।  সে অনেক বার ব্যর্থ হওয়ার পর সফল হয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। আমরাও যদি এই ভাবে চেষ্টা করতে থাকে হয়তো একদিন তার মত সফল হবো।  এই কথা বলার সাথে সাথে তার বন্ধু ইসমাইল তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সে এমনিও ভাবুক টাইপের ছেলে। তার মনে এই ঘটনাটা ভীষণ ভাবে নাড়া দেয়। তখন তার একটা ছড়া মনে পড়ে যায়। যা কোন একদিন কোন একটা প্রতিযোগিতায় শুনেছিল সে।

মনে সাহস থাকলে তোমার
সুন্দর একটা দেশ পসিবল
ধনীর মেয়ে করলে বিয়ে
বউ ভাতেও মেষ পসিবল। 

সৎ থাকিলে মনে দিলে
দেশে প্রতিবাদ পসিবল
থাকিলে কণ্ঠ নসিহতে
রাতে দিনে ভাত পসিবল। 

মুজিব-জিয়ার শিষ্য হলে
বিশ্ব অধিকার পসিবল
অাত্ম বিশ্বাস রাখে যে জন
সামনে চলা তার পসিবল।

দৃঢ় প্রত্যেয় না থাকিলে 
জয় করা সব ইম্পসিবল।

তা পড়ে পড়ে তারা দুজন বন্ধু বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল। তারা মনে মনে সিদ্ধান্তে নিল আজ থেকে পিপড়ার মত চেষ্টা করেই যাবে। 
এদিকে তাদের এক বন্ধু তারা আজ স্কুল না যাওয়ার কথা বাড়িতে বলে দিলে তাদের মা বাবা তাদের খোঁজতে খোঁজতে হয়রান হয়ে গেল। তাদের না পেয়ে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরল অশ্রু চোখে বেদনাময় বুক নিয়ে।

 এমন সময় নূরু আর ইসমাইল বাড়ি পৌঁছে। তারা বাড়ি পৌঁছলে একদিকে মা বাবাদের সন্তান পাওয়ার আনন্দ অন্য দিকে স্কুল পালানোর মত অপরাধ করার জন্য চিন্তিত আর লজ্জিত। 

তাদের শাস্তি করতে চাইলে হঠাৎ তারা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া পিপড়ার ঘটনাটা শুনাতে থাকে। এটাও বলল যে তারা প্রতিজ্ঞা করল আজ থেকে আর স্কুল পালাবে না।
পারুক আর না পারুক চেষ্টা করেই যাবে। এই ভাবে তারা তাদের নয়া জীবন শুরু করল। প্রথমে একটু কষ্ট হলেও আস্তে আস্তে পড়া হাজিরা দিতে সক্ষম হতে লাগল।
একপর্যায়ে সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় নূরু ১ম ও তার বন্ধু ইসমাইল ২য় হয়ে স্কুল ফাস্ট হল।

নূরুর বাবা মফিজের আশা পূর্ণ হলো। তার ছেলে একদিন তাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার হলো আফজল স্যারের মত।

লেখক : হেদায়ত উল্লাহ মহেশখালী

       শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Comments